কোথায় একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার দণ্ডপ্রাপ্তরা

সেই ভয়াল বিভীষিকাময় একুশে আগস্ট। বারুদ আর রক্তমাখা বীভৎস রাজনৈতিক হত্যাযজ্ঞের দিন। ২০০৪ সালের এই দিনে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে সভ্য জগতের এক অকল্পনীয় হামলা চালানো হয় । গ্রেনেডের হিংস্র দানবীয় সন্ত্রাস আক্রান্ত করে মানবতাকে। রক্ত-ঝড়ের প্রচণ্ডতায় মলিন হয়ে গিয়েছিল বাংলা বাঙালির মুখ। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগ কার্যালয় মুহূর্তেই পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় মোট আসামি ছিলেন ৪৯ জন। রায়ে ১৯ জনকে যাবজ্জীবন এবং ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে বর্তমানে কারাগারে আছেন লুৎফুজ্জামান বাবর ও আব্দুস সালাম পিন্টুসহ মোট ৩১ জন। এছাড়া তারেক রহমান এবং হারিছ চৌধুরীসহ ১৮ জনকে মামলার নথিতে পলাতক দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে ৪ জন হারিছ চৌধুরী, মোহাম্মদ হানিফ, মাওলানা তাজউদ্দিন মিয়া ও রাতুল আহমেদ বাবুর বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের নোটিশ রয়েছে। তাদেরও ফেরানো যাচ্ছে না। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পলাতকদের ফিরিয়ে আনতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তারা।

এ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামিরা হচ্ছেন— বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান, চেয়ারপার্সনের সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, কুমিল্লার মুরাদনগরের বিএনপির সাবেক এমপি কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, হানিফ পরিবহনের মালিক মোহাম্মদ হানিফ, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের শীর্ষ নেতা মাওলানা মো. তাজউদ্দিন মিয়া, রাতুল আহমেদ বাবু, মাওলানা মহিবুল মুত্তাকিন, আনিসুল মুরসালিন ওরফে মুরসালিন, মোহাম্মদ খলিল, জাহাঙ্গির আলম বদর, মো. ইকবাল, মাওলানা আবু বকর ওরফে হাফেজ লোকমান হাওলাদার, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা লিটন ওরফে দেলোয়ার হোসেন ওরফে জোবায়ের ও মুফতি শফিকুর রহমান।

তারেক রহমান: বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গত ১০ বছর যাবত লন্ডনে অবস্থান করছেন। গ্রেনেড হামালা মামলায় তাকে যাবজ্জীবন শাস্তি দেয়া হয়েছে। অভিযোগপত্রে তাকে ‘পলাতক’ হিসেবে দেখানো হয়েছে। অর্থ পাচার এবং দুর্নীতির মামলায় এরই মধ্যে তার সাজা হয়েছে।

লুৎফুজ্জামান বাবর: বিএনপি সরকারের সময় তিনি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতাসীন হবার পর বাবরকে আটক করা হয়। সেই থেকে তিনি কারাগারে আছে। গ্রেনেড হামলা মামলায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। এছাড়া ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় এরই মধ্যে লুৎফুজ্জামান বাবরকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে।

আব্দুস সালাম পিন্টু : বিএনপি সরকারের সময় শিক্ষা উপমন্ত্রী ছিলেন আব্দুস সালাম পিন্টু। এছাড়া তখন তিনি টাঙ্গাইল জেলা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। উপমন্ত্রী থাকলেও তারেক রহমানের সাথে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল বলে জানা যায়। গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত।

আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ: জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন তিনি। গ্রেনেড হামলা মামলায় তিনি ছিলেন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আসামী। কিন্তু যুদ্ধাপরাধ মামলায় তার ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় গ্রেনেড হামলা মামলা থেকে তার নাম বাদ দেয়া হয়।

মুফতি হান্নান: উগ্র ইসলামপন্থী দল হরকাতুল জিহাদের নেতা ছিলেন তিনি। গ্রেনেড হামলা মামলার মূল আসামি। তার স্বীকারোক্তির মাধ্যমেই গ্রেনেড হামলা মামলায় মোড় ঘুরে যায় বলে জানান রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবীরা। মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তির পর তারেক রহমান এবং লুৎফুজ্জামান বাবরসহ অনেককেই এ মামলার আসামি করা হয়। সিলেটে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তিনজনকে হত্যার দায়ে ২০১৭ সালে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। সে গ্রেনেড হামলায় ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী আহত হয়েছিলেন। এছাড়া আরো কয়েকটি বোমা হামলার সাথে জড়িত ছিল এ জঙ্গি নেতা।

তাজুল ইসলাম: তিনি মাওলানা তাজউদ্দীন হিসেবে পরিচিত। বিএনপি সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু তার ভাই। গ্রেনেড হামলার পর তাকে ভুয়া পাসপোর্টের মাধ্যমে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বর্তমানে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় আছেন বলে জানা যায়। গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে তাকে।

হারিছ চৌধুরী: বিএনপি সরকারের সময় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব ছিলেন তিনি। তৎকালীন সরকারে যাদের প্রভাব অনেক বেশি ছিল হারিছ চৌধুরী তাদের মধ্যে অন্যতম। গ্রেনেড হামলা মামলায় তাকে যাবজ্জীবন শাস্তি দেয়া হয়েছে। ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতাসীন হবার পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান চৌধুরী। বর্তমানে তার অবস্থান সম্পর্কে কেউ নিশ্চিত নয়। তবে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ একাধিক দেশে আসা যাওয়া করছেন বলে তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলছেন।

মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী: বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হবার পর তাকে আটক করা হয়। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা বা ডিজিএফআই-এর প্রধান ছিলেন মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী। তৎকালীন প্রভাবশালী সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। গ্রেনেড হামলা মামলায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এছাড়া ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় এরই মধ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরীকে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আব্দুর রহিম : জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা বা এনএসআই-এর সাবেক মহাপরিচালক। গ্রেনেড হামলা মামলায় তিনি ছিলেন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আসামি। মামলার রায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। এছাড়া ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় এরই মধ্যে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।

লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক: বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সাবেক এ কর্মকর্তা খালেদা জিয়ার ভাগ্নে। এ মামলায় দীর্ঘ সময় তিনি জামিনে থাকলেও এখন তিনি কারাগারে রয়েছেন।

শহুদুল হক : আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার সময় পুলিশ প্রধান ছিলেন শহুদুল হক। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন। মামলায় দুই বছরের কারাদণ্ড হয়েছে তার। গ্রেনেড হামলা হওয়ার পর তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে রাষ্ট্রপক্ষ। কারণ হামলার পর ঘটনাস্থল একবারও পরিদর্শন করেননি শহুদল হক। শহুদুল হক এক সময় সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। পরে তাকে পুলিশ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর শহুদুল হককে পুলিশ প্রধানের পদে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। বিএনপি সরকারের সময় পুলিশ প্রধান পদে খুব বেশি দিন থাকতে পারেননি তিনি। আদালত অবমাননার দায়ে তাকে সে পদ ছাড়তে হয়েছিল। ২০০৩ সালের এপ্রিল মাস থেকে ২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ এক বছর আট মাস পুলিশ প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন শহুদুর হক।

মোহাম্মদ আশরাফুল হুদা : গ্রেনেড হামলার সময় আশরাফুল হুদা ঢাকার পুলিশ কমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন। ২০০৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২০০৫ সালের ৭ এপ্রিল পর্যন্ত অর্থাৎ চার মাসেরও কম সময় পুলিশ প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন আশরাফুল হুদা। মামলায় দুই বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে তাকে।

খোদাবক্স চৌধুরী: গ্রেনেড হামলার সময় অতিরিক্ত পুলিশ প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন খোদাবক্স চৌধুরী। পরবর্তীতে তিনি পুলিশ প্রধান হয়েছেন। গ্রেনেড হামলা মামলায় তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ: বিএনপির টিকিটে কুমিল্লা থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। গ্রেনেড হামলা মামলায় তাকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয়। মামলার অভিযোগপত্রে তাকে পলাতক দেখানো হয়েছে। ধারনা করা হয়, তিনি সৌদি আরবে পলাতক আছেন।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন আমেরিকায়: বিএনপি সরকারের সময় তিনি প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা বা ডিজিএফআই-এর দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি ছিলেন। পরবর্তীতে সেনা-সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকারের সময় তিনি ডিজিএফআই-এর প্রধান হয়েছিলেন। সে সরকারের মেয়াদ শেষ হলে তিনি আমেরিকায় চলে যান। মামলার কাগজপত্রে তাকে পলাতক দেখানো হয়েছে।

লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম: সাবেক এ সেনা কর্মকর্তা বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করছেন বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর বেরিয়েছে।

সিআইডির সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সাবেক সিনিয়র এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান এবং এএসপি আব্দুর রশিদ বর্তমানে কারাগারে আছেন। এ তিনজন বিএনপি সরকারের সময় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন। গ্রেনেড হামলা মামলার আরেক আসামি হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক হানিফ পলাতক রয়েছেন। তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত।

পলাতকদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে সরকারের উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, পলাতকদের ফিরিয়ে আনার জন্য যা যা করার দরকার সব কিছুই করছে সরকার। এ ব্যাপারে সরকারের উদ্যোগের কোনো ঘাটতি নেই ।

আপনি আরও পড়তে পারেন